Wednesday, May 15, 2019

একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী - যিনি বিজ্ঞানে প্রায় ফেল করেছিলেন – অন্যদের জন্যে তাঁর একমাত্র উপদেশঃ “অধ্যবসায়”


একজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী – যিনি বিজ্ঞানে প্রায় ফেল করেছিলেন – অন্যদের জন্যে তাঁর একমাত্র উপদেশঃ “অধ্যবসায়”


(প্রফেসর জন গর্ডন ও স্টেম-সেল এবং ডিএনএ)

ভাবানুবাদ উৎসঃ রেফারেন্স [১–৩] দেখ।


“তুমি কখনই বিজ্ঞানী হতে পারবে না!” জন গর্ডন (John Gurdon) এর শিক্ষকদের মতে তার জন্যে বিজ্ঞানী হওয়া একটি কাল্পনিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু এই ব্রিটিশ অধ্যাপক, যিনি ২০১২ সালে চিকিত্সাবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী – উচ্চাকাঙ্ক্ষী গবেষকদের জন্যে তাঁর একটাই উপদেশ, “হাল ছেড়ো না!”

জন গর্ডনের বয়স যখন ১৫ বছর, তখন তাঁর শিক্ষকেরা তাঁকে বলেছিলেন যে তার জন্যে বিজ্ঞানী হওয়ার উচ্চাশা নিতান্তই হাস্যকর। তা সত্ত্বেও তিনি ২০১২ সালে চিকিত্সাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন - “মানব শরীরের পরিপক্ক কোষকেও (matured cells) পুনঃ প্রোগ্রাম করে স্টেম-সেল এ রূপান্তরিত করা সম্ভব,” এই আবিষ্কারের জন্য।
Professor John B. Gurdon was the joint winner of the 2012 Nobel Prize in Physiology or Medicine © Gurdon Institute


কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়স্থিত প্রফেসর গর্ডন বলেন “আমি একটি অসমর্থনীয় রিপোর্ট পেয়েছিলাম যেখানে খবর ছিল যে - আমার শিক্ষক কোথাও শুনেছিলেন – আমি একজন বিজ্ঞানী হওয়ার উচ্চাশা পোষণ করি – কিন্তু খবরটি ছিল প্রকৃতই হাস্যকর; কারণ আমার জন্যে বিজ্ঞানের চর্চার অর্থ হবে, ওই শিক্ষক এবং আমার এই দুজনেরই সময়ের সম্পূর্ন অপচয়।”

তাঁর জীবনের এই অভিজ্ঞতা থেকেই উচ্চাভিলাষী বিজ্ঞানীদের জন্যে তাঁর উপদেশের কারনটা বোঝা যেতে পারে, “গবেষণা হক অথবা অন্য কিছুই হক, প্রথম প্রচেষ্টায় না হলেও, হাল ছেড়ো না।”

প্রফেসর জন গর্ডন ডিএনএ

প্রফেসর গর্ডন যখন মাত্র আট বছরের ছিলেন তখন থেকেই জীববিজ্ঞানের প্রতি তাঁর উৎসাহ ছিল, কারণ, তাঁর মা ও খালা সে সময়েই তাঁকে কীটপতঙ্গ সংগ্রহ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। গর্ডন তাঁর সমগ্র শৈশব জুড়েই কীটপতঙ্গ বিষয়ক বইগুলো গোগ্রাসে পাঠ করতেন এবং এভাবেই বিজ্ঞানের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তারপর তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকে আসে সেই হাতুড়াঘাত-সম প্রচণ্ড ঘোষণা, “তুমি কখনই বিজ্ঞানী হতে পারবে না!” কিন্তু তার পরও গর্ডন বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আসক্তি ত্যাগ করেন নাই। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার জন্যে তাঁর পিতামাতা গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন, এবং এটা কাজে লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গর্ডনের জন্যে অনেক ইতিবাচক প্রমাণিত হয়েছিল, কারন, সেখানে ধারনা বা মনন ভিত্তিক জ্ঞানার্জন অধিক গুরুত্তপূর্ন, যা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার নিছক মুখস্থ করা থেকে আলাদা।

প্রতিভার বিকাশ


স্নাতকার্থী বছরগুলোতেই বোঝা গিয়েছিল যে বিজ্ঞানী হওয়ার মত যোগ্যতা জন গর্ডনের রয়েছে (অর্থাৎ তাঁর সম্পর্কে পূর্ববর্তী শিক্ষকের ধারনা ভুল ছিল)। তবে তাঁর প্রকৃত পেশাগত উন্নতি শুরু হয় ১৯৫৬ থেকে যখন তিনি স্নাতকোত্তর গবেষণা শুরু করেন।

এই সময়টা ছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশাল উত্তেজনাকর সময়। কারণ, মাত্র তিন বছর পূর্বে ডিএনএ মলিকুলের (DNA molecule) পেঁচাল গঠন আবিষ্কৃত হয়, যার জন্যে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রীক নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন [২]*। ডিএনএ হচ্ছে মানব শরীরের কোষ-মধ্যস্থিত একটি সূত্রাকার অণূ যার মধ্যে জীবনের সংকেতপদ্ধতি (code of life) লিপিবদ্ধ থাকে। এই আবিষ্কার প্রজনন-বিজ্ঞানকে (Genetics) এবং সেই সঙ্গে প্রজনন-বিজ্ঞানে উৎসাহীদেরকেও খ্যাতিমান করে তোলে।

প্রফেসর গর্ডন হলেন এরকমই একজন বিজ্ঞানী যিনি প্রজনন-বিজ্ঞান এবং ক্রমবিকাশী জীববিজ্ঞানে উৎসাহী ছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, “ডিএনএ সূত্র (DNA strand) কোন প্রক্রিয়ায় মানব-অঙ্গ এবং প্রজাতিদেরকে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে রাখে, যার জন্যে বিভিন্ন অঙ্গাদি তাদের নিজস্ব প্রকৃতিতে বিকাশ করে?” “প্রাথমিক স্তরে যে সমস্যা আমাকে সবচেয়ে ভাবিত করে রেখেছিল,” গর্ডন বলেন, তা হল, “শরীরের সমস্ত কোষের ডিএনএ অণুগুলি কি একই রকম? না আলাদা আলাদা?” এটা মূলত একটি বিশাল প্রশ্ন, জীব-বিজ্ঞানীরা শত বছর ধরে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলেন – এবং গর্ডন এই প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে করনে তাঁকে “ক্লোনিং এর ধর্মপিতা” বা (“the godfather of cloning”) বলা হয়। তিনি আবিষ্কার করেন, “কোষের বিশেষত্ব প্রতিবর্তনযোগ্য” (specificity of cells is reversible)। তিনি একটি পরীক্ষা চালান যেখানে, ব্যাঙ্ এর ডিম্বকোষের অপরিপক্ক কোষকেন্দ্রক (nucleus) বের করে নিয়ে তিনি অন্ত্রের কোষ থেকে সংগ্রহীত পরিপক্ক কোষের কোষকেন্দ্রক স্থাপন করেন। তারপরও এই পরিবর্তিত ডিম্বকোষটি একটি সাধারণ সুস্থ বেঙাচি রূপে বিকাশ করে। এতে প্রমাণিত হয় যে, পরিপক্ক কোষের ডিএনএতেও বেঙাচি গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার কোষ তৈরী করার যথাযথ তথ্যাদির উপাদান বর্তমান ছিল। এই পদ্ধতিকে বলা হয় “কোষকেন্দ্রক প্রতিস্থাপন” (nuclear transplantation)।

১৯৯৬ সালে “ডলি” নামের একটি ভেড়ার [৩] ক্লোন করতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, মূলতঃ তা ছিল প্রফেসর গর্ডনের ব্যাঙ্ এর কোষকেন্দ্রক প্রতিস্থাপনের মতই একটি প্রযুক্তি। এই আবিষ্কারের জন্যেই প্রফেসর জন গর্ডন এবং প্রফেসর শিন্‌ইয়া ইয়ামানাকা (Shinya Yamanaka) নোবেল প্রাইজ অর্জন করেছিলেন। ইয়ামানাকার আবিষ্কার ছিল ইঁদুরের আস্ত পরিপক্ক কোষকে পূনঃ প্রোগ্রাম করে অপরিপক্ক স্টেম-কোষে পরিনত করা। এই পরিবর্তিত কোষগুলি ঠিক ভ্রূণ হতে প্রাপ্ত বহুমুখি কর্মশক্তিসম্পন্ন (versatile) স্টেম-কোষের মতই, অর্থাৎ এই পরিবর্তিত কোষগুলি শরীরের যে কোন অঙ্গের নিজস্ব কোষে পরিনত হতে পারে। এই আবিষ্কার প্রমান করে যে, বহুমুখি কর্মশক্তিসম্পন্ন স্টেম-কোষ তৈরী করার জন্যে আর ভ্রূণ ধ্বংস করবার দরকার নাই। (কারন, এই আবিষ্কারের আগে, ভ্রূণই ছিল স্টেম-কোষএর একমাত্র উৎস)।

স্টেম-কোষের গুরুত্ত


স্টেম-কোষ শরীরের অনেক গুরুত্তপূর্ণ ব্যবহারে লাগতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গর্ডন বলেন, স্টেম-সেলগুলোকে কোন রোগের সেল রূপে প্রবর্ধন করা যেতে পারে (cell cultures) এবং ওই কৃত্রিমভাবে জন্মানো রোগাক্রান্ত সেলগুলোর উপর নতুন কোন ঔষধের কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা যেতে পারে। অথবা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের, যেমন, হৃদপিন্ড, যকৃত, অথবা মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোর প্রতিস্থাপন কোষ হিসাবে কৃত্রিমভাবে জন্মানো কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। কাজেই, ভবিষ্যতে স্টেম-কোষের ব্যবহার জীববিজ্ঞানের ধারাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করার সম্ভাবনা রাখে।

পর্ডন আরো বলেন, আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ। “স্টেম-কোষ গবেষনার উপকারাদি আরও সহজবোধ্যভাবে যদি তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে খুব ভাল হবে। এবং এ ব্যাপারে স্কুলের শিক্ষরেরা একটি ভূমিকা পালন করতে পারেন।”
---------------------

*এখানে উল্লেখযোগ্য, যদিও জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রীক কে ডিএনএ এর দ্বৈত স্ক্রু-পেঁচ গঠনাকৃতি (double helix structure of DNA) আবিষ্কারের কৃতিত্ত দেওয়া হয়, কিন্তু রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন নামক একজন “এক্স-রে বিচ্ছুরণ” বিশেষজ্ঞ ১৯৫০ সালে ডিএনএ প্রটিনের এক্স-রে চিত্র তৈরী করেন যেখানে ওই ডিএনএ প্রটিনের স্ক্রু-পেঁচ গঠন (helical shape) প্রথম দেখা যায়। ওয়াটসন এবং ক্রীক প্রকৃতপক্ষে ফ্রাঙ্কলিনের ওই ছবি দেখার পরই বুঝতে পারেন যে ডিএনএ অণুকে খুঁজে পেতে হলে তাদেরকে লম্বা, বিনুনির মত একটি আকৃতি খুঁজতে হবে।

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, “কেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় নাই?” অনেকেই মনে করেন এর জন্যে তাঁর অকাল মৃত্যুই দায়ী; কারন, নোবেল প্রাইজ শুধু জীবিত মানুষকেই দেওয়া হয়।


রেফারেন্সেস

যোগাযোগ

Anis Rahman, PhD
email: anis@anisrahman.org